সিউয়েজ কি - Industrial Sewage - what is water carriage system
সিউয়েজ কি - Industrial Sewage - what is water carriage system
শুচি প্রযুক্তিবিদ্যা (Sanitary Engineering)
শুচি প্রযুক্তিবিদ্যা জনজীবনের স্বাস্থ্যরক্ষার কারিগরি কৌশলমাত্র। পানি ও মুক্ত বায়ুর জোগান, তা নির্মল রাখা এবং মানুষ ও অন্যনা প্রাণীর পরিত্যক্ত মলমূত্র ও ময়লা-আবর্জনাকে স্বাস্থ্যসন্মতভাবে দ্রুত অপসারণ করে অক্ষতকারক বস্তুতে রূপান্তর করার কৌশলকে বিজ্ঞানের ভাষায় স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং বা শুচি প্রযুক্তিবিদ্যা বলা হয়। এর সাহায্যে জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর সকল রকমের বর্জ্য পদার্থ, ময়লা পানি ও মল-মূত্র দ্রুত নিরাপদে সুষ্ঠুভাবে নিষ্কাশন করা সম্ভব।এ কাজের চারটি অংশ যথা :
ক) সকল বর্জ্য পদার্থের সহজ ও সুষ্ঠু সংগ্রহ (Collection)।খ) সংগৃহীত বর্জ্য পদার্থ নর্দমা ও পাইপ দিয়ে শোধন ও অপসারণ কেন্দ্রে দ্রুত নিরাপদে বহন (Conveyance)।
গ) শোধন ও অপসারণ কেন্দ্রে এ সকল ক্ষতিকারক বর্জ্য পদার্থের রূপান্তর ও পরিশোধন করে দ্রুত নিরাপদ স্থানে অপসারণ (Disposal after Treatment and Purification) |
ঘ) সংগ্রহ থেকে অপসারণ কাজের সময়ে পাঁচে যাওয়া বর্জ্য পদার্থ থেকে দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত গ্যাস ও যাবতীয় পদার্থের নিঃসরণ ও বাতাস অনুকূলকরণ (Ventilation & Air-conditioning)।
সিউয়েজের উৎস
সিউয়েজ আসলে পানিময় মল বা মলময় পানি। ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ, অফিস ইত্যাদি থেকে মানুষ ও অপরাপর জীব-জন্তুর মল-মূত্র এবং সেই সাথে গোসলখানা, রান্নাঘর, হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা, কসাইখানা ইত্যাদি থেকে আগত একসাথে মেশানো তরল নোংরা পানিকে সিউয়েজ বলে। সিউয়েজে রাস্তা ধোয়া বৃষ্টির পানিও থাকতে পারে। সিউয়েজের শতকরা ৯৯.৫% পানি এবং বাকি ০.৫% পচনশীল দুর্গন্ধযুক্ত ও ক্ষতিকারক পদার্থ।তাই এটি খোলাভাবে ও প্রকাশ্যে পরিবহন করা উচিত নয়। সিউয়েজ প্রাথমিক অবস্থায় প্রায় গন্ধহীন এবং ক্ষারধর্মী হয়। ৫-৬ ঘণ্টা পর তা রং বদলে কালো বা ছাই রং ধারণ করে এবং অ্যামোনিয়া, কার্বন ডাই অক্সাইড মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উৎপন্ন করতে শুরু করে। এটি তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত হয়। এ অবস্থায় সিউয়েজ অম্লধর্মী হয়।
উৎস অনুসারে সিউয়েজকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা :
ক) সিউয়েজ (Sewage treatment system)খ) শিল্প সিউয়েজ (Industrial Sewage)
গ) স্টর্ম সিউয়েজ (Storm Sewage)
ক) বাস্তুজ বসতবাড়ি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, অফিস ইত্যাদির বান্নাঘর, গোসলখানা, বেসিন, বাথটাব ইত্যাদি থেকে নির্গত ধোয়ানিসহ মল-মূত্রকে বাস্তুজ সিউয়েজ বলে।
খ) শিল্প সিউয়েজ
শিল্প এলাকার কাপড়ের কল, চটকল, কগজের কল, ওষুধ কারখানা ইত্যাদি থেকে নির্গত তরল আবর্জনাকে শিল্পজ সিউয়েজ বলে।
গ) স্টর্ম সিউয়েজ
দুর্গন্ধহীন বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশিত না হলে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় পানি জমে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে এবং জনজীবনেরও অনেক ক্ষতি সাধন করতে পারে। তাই বৃষ্টির পানি আলাদাভাবে খোলা ড্রেন দিয়ে নিষ্কাশিত হলে তাকে বলা হয় স্টম ওয়াটার। আবার অনেক সময় বৃষ্টির পানি সিউয়েজের সাথে একত্রে ভূ-গর্ভস্থ সিউয়ার পাইপ দিয়ে নিষ্কাশন করা হয়। বৃষ্টির পানি মেশানো এ সিউয়েজকে যুক্ত সিউয়েজ (Combined Sewage) বলে।
সিউয়েজ কি - Industrial Sewage - what is water carriage system
সিউয়ারেজ (Sewerage) ও সিউয়ারেজের প্রকারভেদ
সিউয়েজকে শোধন করতে শোধনাগারে নিতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। শোধন ছাড়া যাবতীয় ব্যবস্থাকে সিউয়ারেজ বলে। ব্যবস্থাগুলো নিম্নরূপ :ক) প্লাম্বিং ফিচার স্থাপন
খ) সিউয়ার পাইপ নির্মাণে বা স্থাপন
গ) সিউয়ার পাইপ সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো (Sewer Appurtenances) যথা-ম্যানহোল, ল্যাম্প হোল, রেগুলেটর, ফ্লাশ ট্যাঙ্ক ইত্যাদি নির্মাণ।
ঘ) সিউয়েজকে এক ঢাল হতে অপর চালে নেয়ার জন্য পাম্প ঘর নির্মাণ ও পাম্প স্থাপন।
সিউয়ার দিয়ে সিউয়েজকে পানিপ্রবাহের মাধ্যমে শোধনাগারে নেয়ার ব্যবস্থাকেই সিউয়ারেজ সিস্টেম বলে। সিউয়ারেজ সিস্টেমকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, অর্থাৎ তিনটি পদ্ধতিতে সিউয়ার পাইপ বসানো হয়, যথা
১) যুক্ত পদ্ধতি
২) স্বতন্ত্র পদ্ধতি
৩) আংশিক স্বতন্ত্র পদ্ধতি।
যুক্ত পদ্ধতিতে সিউয়ার পাইপের ভিতর দিয়ে বাস্তুজ সিউয়েজ ও বৃষ্টির পানি উভয়ই একত্রে প্রবাহিত হয়। কিন্তু স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রকার সিউয়েজ পাইপ দিয়ে প্রবাহিত হয়। অনেক সময় যুক্ত পদ্ধতিতে সিউয়ারে সিউয়েজ প্রবাহের মাত্রা কমাতে রেগুলেটর ব্যবহার করে সিউয়েজকে আংশিক স্বতন্ত্র করে দেয়া হয় এবং এই আংশিক স্বতন্ত্র পদ্ধতি।
জনপ্রতি সিউয়েজের পরিমাণ
দৈনিক জনপ্রতি সিউয়েজের পরিমাণ ৯০ থেকে ১৩৫ লিটার। তবে সেপটিক ট্যাংক ডিজাইন করার সময় ১১০ লিটার ধরে ডিজাইন করা হয়।খাতওয়ারি হিসাব নিচে পেশ করা হলো
পায়খানা থেকে ২৭-৩৭ লিটার
গোসলখানা থেকে ৪৬.৬৮ লিটার
বিভিন্ন ধোয়া মোছা থেকে ১২-২২ লিটার
রান্নাঘর থেকে ৫-৮ লিটার
মোট = ৯০-১৩৫ লিটার
সিউয়েজ নিষ্কাশন পদ্ধতি বসত এলাকা থেকে সিউয়েজ নিষ্কাশনের কাজকে মোট দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা :
ক) কনজারভেন্সি পদ্ধতি (Conservancy System)খ) পানিবাহিত পদ্ধতি (Water Carriage System)
ক) কনজারভেন্সি পদ্ধতি (Conservancy System)
এ পদ্ধতিতে কোন নির্দিষ্ট বিশেষ স্থানে বর্জ্য পদার্থ জমা করা হয়। সেখান থেকে ঠেলাগাড়ি বা ট্রাকে ভরে বসত এলাকা থেকে দূরে কোনো নির্ধারিত জনশূন্য এলাকায় পতিত জমিতে নালা পদ্ধতিতে ঢেলে দিয়ে আসা হয়। সেখারে পচনশীল অংশ প্রাকৃতিক নিয়মে মাটির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এবং বাদ বাকি অংশ শুকিয়ে গেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়।বৃষ্টির পানি আর ধোয়ানিকে কাঁচা নালা নর্দমা দিয়ে বসত এলাকার অদূরে কোনো ডোবা বা খালে ফেলে দেয়া হয়। আর সিউয়েজ অংশ (মলমূত্র) মেঘর খাটা পায়খানা থেকে মেথর ও বিশেষ ধরনের গাড়ির (গরু বা ইঞ্জিন চালিত) সাহায্যে শহর থেকে দূরে বসতহীন এলাকার নির্দিষ্ট পতিত জমিতে নালা পদ্ধতিতে ঢেলে দেয়া হয়। আজকাল সেপটিক ট্যাংক ও কুয়া পায়খানা ব্যবহারের ফলে কনজারভেঙ্গি পদ্ধতি শহর এলাকা থেকে উঠে যাচ্ছে। তবে সেপটিক ট্যাংকের স্লাজ অপসারণের জন্য পতিত জমির প্রয়োজন হয়। খাল বা নদীতে সালেজ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে না পারলে সোক-অয়েল তৈরি করে তাতে নিষ্কাশন করা হয়।। এ পদ্ধতিতে বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার ও নিষ্কাশনের পুরো কাজটিই অস্বাস্থ্যকর। এ পদ্ধতি সহজ এবং প্রাথমিকভাবে এতে খরচ কম।
সুবিধা
১/ এ পদ্ধতিতে প্রাথমিক খরচ কম।২/ দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন হয় না।
৩/ ব্যয়বহুল সিউয়ার পাইপ বসাতে হয় না।
৪/ এ পদ্ধতিতে সিউয়ার লাইন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ঝামেলা হতে মুক্ত
অসুবিধা
১. এ পদ্ধতি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।২. মলমূত্র খোলা অবস্থায় থাকে বলে মশা-মাছির উপদ্রব বেশি এবং আশেপাশের পরিবেশ দুর্গন্ধে ভরে
৩. মলমূত্রবাহী গাড়ি রাস্তা দিয়ে চলার সময় দুর্গন্ধে পথচারীদের অসহনীয় অবস্থায় পড়তে হয়।
৪. এ পদ্ধতি কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল।
খ) পানিবাহিত পদ্ধতি (Water Carriage System)
এ পদ্ধতি সিউয়েজ নিষ্কাশনের একটি অত্যাধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় প্রচুর পরিমাণ পানির
সাহায্যে বাস্তুজ এবং অন্যান্য সিউয়েজ সিউয়ারের মাধ্যমে অপসারণ করে শোধন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। শোধন কেন্দ্রে সিউয়েজকে নানা উপায়ে শোধন করে কৃষি কাজের সার হিসেবে, পানি সেচ অথবা নিচু জমি ভরাট কাজে ব্যবহার করা হয়। সিউয়েজ শোধনের সময় সিউয়েজ থেকে উৎপন্ন গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ পদ্ধতিতে বর্জ্য পদার্থ অপ্রয়োজনীয় না হয়ে মানুষের কাজে লাগানো যায়। তবে প্রাথমিকভাবে এটি ব্যয় সাপেক্ষ।সুবিধা
ক) এ পদ্ধতি স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি করে না।খ) পরিবেশ দূষিত হয় না।
গ) দুর্গন্ধ ছড়ায় না।
ঘ) মশা-মাছির উপদ্রব হয় না।
ঙ) এ পদ্ধতিতে পায়খানা-প্রস্রাবখানা দালান সংলগ্ন (Attached) নির্মাণ করা যায়।
অসুবিধা
ক) এ পদ্ধতিতে প্রাথমিক খরচ খুব বেশি।খ) ব্যয়বহুল সিউয়ার লাইন করতে হয়।
গ) মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ খুব বেশি।
ঘ) দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন হয়।
ঙ) এ পদ্ধতিতে নতুন সিউয়ার লাইন স্থাপন ও লাইন মেরামত রাস্তায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়।
সিউয়েজ পরিশোধন পদ্ধতি
সিউয়েজ একদিকে যেভাবে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, অপরদিকে তেমনি দৃষ্টিকটু। সিউয়েজে পানির পরিমাণশতকরা ৯৯.৫ ভাগ এবং বাকি ০.৫ ভাগ পচনশীল জৈব পদার্থ। এতে নানা প্রকার রোগজীবাণু থাকে।
পচনশীল দ্রব্যগুলো হতে দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়ে পরিবেশকে দূষিত করে। রোগ জীবাণুগুলো পানির সাথে মিশে নানা প্রকার রোগ ছড়াতে পারে। তাই সিউয়েজ পরিশোধনের প্রয়োজন হয়। পরিশোধনের পর সিউয়েজকে নিরাপদে নদী-নালায় নিষ্কাশন করা হয় বা সিউয়েজ দিয়ে সেচ কাজ করা যায়। অপরিশোধিত সিউয়েজ খুবই ক্ষতিকর, দুর্গন্ধ ছড়ায়, রোগ জীবাণু সৃষ্টি করে এবং পরিবেশকে দূষিত করে। এ ক্ষতিকারক সিউয়েজকে অক্ষতিকারক পদার্থে রূপান্তর করাকেই সিউয়েজ শোধন বলে। সিউয়েজ শোধন (Treatment) কথাটির অর্থ হলো দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ও ক্ষতিকারক সিউয়েজকে বিভিন্ন শোধন প্রক্রিয়ায় শোধন করে এমন অবস্থায় রূপান্তর করা, যাতে জনস্বাস্থ্য নিরাপদ এবং গুচি ও শুদ্ধতা বজায় থাকে।